প্রাণরস বা হরমোনজনিত অস্বাভাবিকতা (10.5)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৫) - জীববিজ্ঞান (নতুন সংস্করণ) সমন্বয় | - | NCTB BOOK
86
86

(a) থাইরয়েড সমস্যা


সমুদ্রের পানিতে আয়োডিন থাকায় সামুদ্রিক মাছ মানুষের খাদ্যে আয়োডিনের অন্যতম মূল উৎস। আয়োডিনযুক্ত খাবার খেলে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয়। দেখা গেছে, সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত এলাকা যেমন হিমালয়ের পাদদেশে নেপাল কিংবা বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে গলগণ্ড বা গয়টার রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধা পায়। গায়ের চামড়া খসখসে হয়, মুখমণ্ডল গোলাকার এবং চেহারায় স্বাভাবিক শিশুদের থেকে বৈসাদৃশ্য থাকে। আয়োডিনের অভাবে হরমোন এর উৎপাদন ব্যাহত হলে শিশুদের বৃদ্ধির বিকাশ কমে যায়। এই জন্য খাদ্যে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায়। এছাড়া কলা, ফলমূল, কচু, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে পঞ্চম অধ্যায়ে আরও আলোচনা করা হয়েছে।


(b) বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস (Diabetes)


অগ্ন্যাশয়ের ভিতর আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যানস নামক এক ধরনের গ্রন্থি আছে, এই গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন (Insulin) নিঃসৃত হয়। ইনসুলিন হলো এক ধরনের হরমোন, যা দেহের শর্করা পরিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। অগ্ন্যাশয়ে যদি প্রয়োজনমতো ইনসুলিন তৈরি না হয় তবে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায়, প্রস্রাবের সাথে গ্লুকোজ নির্গত হয়। এ অবস্থাকে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস মেলিটাস (সংক্ষেপে: ডায়াবেটিস) বলে। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের, টাইপ-1 এবং টাইপ-2। টাইপ-1 এ আক্রান্ত রোগীর দেহে একেবারেই ইনসুলিন তৈরি হয় না। তাই নিয়মিতভাবে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নিতে হয়। অন্যদিকে টাইপ-2 রোগীর দেহে আংশিকভাবে ইনসুলিন তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ঔষধ, অগ্ন্যাশয় কোষকে শরীরের জন্য পরিমিত ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে। তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসেও কোনো না কোনো পর্যায়ে ইনসুলিনের স্থায়ী ঘাটতি হয়ে যেতে পারে কিংবা বিভিন্ন অসুখ বা চিকিৎসাপদ্ধতির অংশ হিসেবে সেই সব ঔষধ বন্ধ রাখতে হতে পারে, তখন ইনসুলিন ছাড়া উপায় থাকে না। এ রোগটি সাধারণত বংশগতি এবং পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে। এটি সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ নয়।
রক্ত ও প্রস্রাবে গ্লুকোজের মাত্রা পরিমাণের চেয়ে বেড়ে গেলে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলো হলো ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, অধিক পিপাসা লাগা, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত খাবার খাওয়া সত্ত্বেও দেহের ওজন কমতে থাকা, দুর্বল বোধ করা, চোখে কম দেখা, চামড়া খসখসে ও রুক্ষ হয়ে যাওয়া, ক্ষতস্থান সহজে না শুকানো ইত্যাদি।
পূর্বে ধারণা করা হতো কেবল বয়স্কদের এ রোগটি হয়। এ ধারণাটি সঠিক নয়। ছোট-বড় সব বয়সে এ রোগ হতে পারে। তবে যারা কায়িক পরিশ্রম করেন না, দিনের বেশির ভাগ সময় বসে কাজ করেন অথবা অলস জীবন যাপন করেন, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাছাড়া স্থূলকায় ব্যক্তিদের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেহেতু এ রোগ বংশগত, তাই কোনো ব্যক্তির বাবা, মা, দাদা, দাদির এ রোগ থাকলে তার এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। বংশগতভাবে অনেক শিশুর দেহে ইনসুলিন উৎপাদন কম হয়, ফলে শিশুটি ইনসুলিন ঘাটতিজনিত অসুস্থতায় ভুগতে থাকে।
ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা: রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয়ের মাধ্যমে এ রোগ নির্ণয় করা যায়। চিকিৎসা করে ডায়াবেটিস রোগ একেবারে নিরাময় করা যায় না, কিন্তু এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডাক্তারদের মতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনটি 'D' মেনে চলা অত্যাবশ্যক। এগুলো হলো: Discipline, Diet ও Drug.
(i) শৃঙ্খলা (Discipline): একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য তার সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা মহৌষধস্বরূপ। এছাড়া নিয়মিত এবং ডাক্তারের পরামর্শমতো পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, রোগীর দেহের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বিশেষভাবে পায়ের যত্ন নেওয়া, নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা করা এবং দৈহিক কোনো জটিলতা দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
(ii) খাদ্য নিয়ন্ত্রণ (Diet): ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করা, মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার করা ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত এবং সময়মতো খাদ্য গ্রহণ করা। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবারের মেনু অনুসরণ করলে সুফল পাওয়া যায়। তবে যার ডায়াবেটিস নেই, তার মিষ্টি খাওয়া বা না খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নেই।
(iii) ঔষধ সেবন (Drug): ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ সেবন করা উচিত নয়। ডাক্তার রোগীর শারীরিক অবস্থা বুঝে ঔষধ খাওয়া বা ইনসুলিন নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হবে। ঠিকমতো চিকিৎসা না করা হলে রোগীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে বা বেড়ে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই রোগী বেহুঁশ হয়ে পড়তে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। যদি ডায়াবেটিস রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান, তখন তাকে বসিয়ে গ্লুকোজ বা চিনির পানি খাইয়ে দিলে অনেক সময় খারাপ পরিণতি এড়ানো যেতে পারে।


(c) স্ট্রোক (Stroke)


মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটার কারণে স্নায়ুতন্ত্রের কাজে ব্যাঘাত ঘটলে তাকে স্ট্রোক বলে। স্ট্রোক হয় মস্তিষ্কে, হৃৎপিণ্ডে নয়; যদিও এ ব্যাপারে অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা রক্তনালির ভিতরে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়া- এই দুইভাবে স্ট্রোক হতে পারে। এর মধ্যে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক বেশি মারাত্মক। সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হতে পারে।
রোগের লক্ষণ: এই রোগের লক্ষণ হঠাৎ করেই প্রকাশ পায়। লক্ষণগুলো হলো: বমি হয়, প্রচণ্ড মাথাব্যথা
হয়, কয়েক মিনিটের মধ্যে রোগী সংজ্ঞা হারায়, ঘাড় শক্ত হয়ে যেতে পারে, মাংসপেশি শিথিল হয়ে যায়, শ্বসন এবং নাড়ির স্পন্দন কমে যায়, মুখমণ্ডল লাল বর্ণ ধারণ করে। অনেক সময় অবশ্য খুব মারাত্মক উপসর্গ ছাড়াই শুধু মুখ বেঁকে যাওয়া বা অল্প সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়ে আবার জ্ঞান ফিরে আসা- স্ট্রোকের এ জাতীয় লক্ষণ দেখা যায়। স্ট্রোক কতটা মারাত্মক তা বলতে হলে অন্তত কয়েক দিন রোগীকে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন, সে সময়ে তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখতে হয়। তাই, স্ট্রোক হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হবে এবং যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। উপযুক্ত চিকিৎসা করা হলে রোগী অনেক সময় বেঁচে যায়, তবে যদি রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক হয়, তাহলে বাঁচার নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। রোগী যদি বেঁচে যায়, তাহলে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর সে তার সংজ্ঞা ফিরে পায়। তবে রোগী কিছুটা ছটফট করে এবং আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে যাওয়া অঙ্গে দৃঢ়তা ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে এলেও বাক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে রোগীর কথা জড়িয়ে যায়। পক্ষাঘাত বা অবশ হয়ে যাওয়া অঙ্গ (যেমন: হাত) সংলগ্ন পেশি নড়াচড়ায় শক্তি ক্রমশ ফিরে আসে কিন্তু হাত দিয়ে সূক্ষ্ম কাজ করার ক্ষমতা সাধারণত পুরোপুরিভাবে ফিরে আসে না। চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায়ে আরোগ্য লাভ দ্রুত হতে থাকে কিন্তু দুমাস পরে উন্নতি ক্রমশ কমে আসে। হঠাৎ আক্রমণে যে স্নায়ু সাময়িকভাবে কার্যক্ষমতা হারায়, সেগুলো দ্রুত আরোগ্য লাভ করে এবং কার্যক্ষমতা ফিরে পায়। আর যেসব স্নায়ু সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলোর কর্মক্ষমতা চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যায়।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা রক্ত জমাট বেঁধেছে কি না তা নির্ণয় করে এই রোগ
সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই রোগটির সঠিক কারণ অনেক সময় নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব নয়, তবে মস্তিষ্কে জমে থাকা রক্ত অনেক সময় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করার প্রয়োজন হতে পারে। রোগীর উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা, রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী সম্ভব হলে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। রোগীকে উপযুক্ত শুশ্রুষা, মলমূত্র ত্যাগের সুব্যবস্থা করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পথ্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। প্রয়োজনবোধে রোগীকে নলের সাহায্যে খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ মোতাবেক অবশ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গ নির্দিষ্ট নিয়মে নড়াচড়া করানো দরকার, এতে ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গের অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যাওয়া রোধ করা সম্ভব হয়। রোগীর জ্ঞান ফিরে এলে নিজ প্রচেষ্টায় নড়াচড়া করতে উৎসাহিত করা উচিত।
প্রতিরোধের উপায়: ধূমপান পরিহার করা, যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাদের নিয়মিত ঔষধ সেবন করা, দুশ্চিন্তামুক্ত, সুন্দর এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করা।

Content added By
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion